(Baidyanath Shakti Peeth in Bengali) বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠের বর্তমান অবস্থান কোন স্থানে? দেবী সতীর কোন অঙ্গ এখানে পতিত হয়েছে? বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী কি? কিভাবে আরাধনা করা হয়? এই মন্দিরের তাৎপর্য কি? জানুন সবকিছু বিস্তারিত।
আমরা সকলেই জানি যে, দেবীর দেহকে খন্ড-বিখন্ড করা হয়েছিল, যা কিনা ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত হয়ে ৫১ টি জায়গায় পড়েছিল, আর সেখানে তৈরি হয়েছিল এক একটি সতীপীঠ অথবা শক্তিপীঠ, বৈদ্যনাথ মন্দিরটি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের দেওঘর জেলায় অবস্থিত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এখানে সতীর হৃদয় পড়েছিল যেটাকে আমরা হৃৎপিণ্ড ও বলতে পারি, এখানে অধিষ্ঠিত দেবী জয় দুর্গা ও ভৈরব হলেন বৈদ্যনাথ। শক্তিপীঠ হওয়ার পাশাপাশি এটি একটি শৈব তীর্থও বটে।
এছাড়া ১২ টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হলো এই সতীপীঠ বৈদ্যনাথ, শিবরাত্রি উদযাপনের জন্য প্রতিবছর এখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমা হয়। দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দিরের মাহাত্ম্য অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের কাছে অনেক খানি গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠ:
শক্তিপীঠের নাম | বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠ |
স্থান | বৈদ্যনাথ মন্দির, দেওঘর, ঝাড়খণ্ড |
দেশ | ভারত |
দেবীর অংশ | হৃদয় |
শক্তির নাম | জয়দুর্গা |
বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী:
তবে এক একটি তীর্থস্থান, মন্দিরের পিছনে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী, সেই অনুসারে মাতা সতীর বাবার দ্বারা স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহ ত্যাগ করেছিলেন। আর মাতা সতীর দেহ ত্যাগের খবর দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে পৌঁছতে না পৌছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন, আর তিনি দেবীকে অনেক খানি ভালবাসতেন, সেই কারণে পাগল উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন সতীর মৃত্যুতে। সতীর মৃত দেহ দেখে তিনি রাগে একেবারে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন, তখনই সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন।
মহাদেবের এই তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা যায়, উপায় না দেখে তখন শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহকে খন্ড খন্ড করে ৫১ টি খন্ডে বিভক্ত করে ফেলেন। আর সেই দেহ খণ্ড গুলি যে জায়গায় পড়েছিল সেখানে এক একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয়, আর সেখান থেকে এটি একটি শক্তিপীঠ, ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে।
এছাড়া অন্য দিক থেকে দেখা যায় যে, শৈব পুরাণে এই মন্দিরকে দুটি আত্মার মিলনস্থল বলেও বর্ণনা করা হয়েছে, আবার মৎস পুরানে এই মন্দিরের ভৈরবকে আরোগ্য বৈদ্যনাথ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার অর্থ হল যিনি সর্বরোগহারি, রামায়ণের কাহিনীতেও এই বৈদ্যনাথ মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণের পুরান কাহিনী অনুযায়ী দেখা যায় যে, ত্রেতা যুগের শিব ভক্ত দশানন রাবণ একবার চেয়েছিলেন শিবকে কৈলাস থেকে নিয়ে এসে লঙ্কায় প্রতিষ্ঠিত করে পূজা করতে।
সেই চিন্তা থেকেই তিনি দুর্জয় ও অমর হওয়ার বাসনাতে কৈলাস আক্রমণ করে বসেন, সেই সময় দ্বার রক্ষী ছিল নন্দী তাকে রাবণ অর্ধ মানব অর্ধ পশু বলে অপমান করলে নন্দী রাবন কে অভিশাপ দেন যে বন্য বানর আর মানুষের হাতে স্বর্ণলঙ্কা শহর আগুনের বিনাশ ঘটবে খুব শীঘ্রই।
আর এর ফলে খুবই রেগে যান রাবণ, তারপরে নন্দীকে আছড়ে ফেলে যখন পুরো কৈলাস পর্বত কে তুলে ধরলেন সেই সময় শিব বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে পর্বত কে আবার মাটিতে বসিয়ে রাবণকে কঠোর তপস্যা করার আদেশ দেন।
আর সেই কঠিন তপস্যা শুরু করেন রাবণ, নিজের নয়টি মাথা বলি দিয়ে দেন তিনি এই তপস্যার মধ্যে দিয়ে। অবশেষে শেষ মাথাটি বলি দেওয়ার সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন মহাদেব, আর রাবণের মনের ইচ্ছা শুনে তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন।
এছাড়া তিনি তার তপস্যয় সন্তুষ্ট হয়ে চন্দ্রহাস নামে একটি বিরাট শক্তিশালী অস্ত্রও রাবণকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন রাবন, শেষমেষ শিব আত্মলিঙ্গ অর্পণ করে লঙ্কার প্রতিষ্ঠা করতে বলেন তাকে।
আর একই সঙ্গে রাবনকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, কৈলাস থেকে লঙ্কার পথে যাওয়ার সময় কোথাও যদি রাবণ শিবলিঙ্গ কে কোন জায়গায় রেখে দেন, তাহলে তিনি সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন। আর সেই মতোই তিনি লঙ্কার পথে যাওয়ার সময় দুর্ভাগ্যক্রমে মূত্র ত্যাগ করতে গিয়ে এই শিবলিঙ্গ একটি জায়গায় রেখে দিয়েছিলেন, আর সেখানেই শিবলিটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
ঐতিহাসিক কাহিনী:
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী জানা যায় যে, মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ এই বৈদ্যনাথ শক্তিপীঠের মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন, আবার অন্যদিকে জানা যায় যে, দেওঘর রাজ্যের রাজা দ্বিধাউর এই মন্দির নির্মাণের কাজে অনেকখানি সহযোগিতা করেছিলেন, তার পাশাপাশি পরবর্তীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই মন্দিরটির সংস্কার করে অনেকখানি সাহায্য করে।
এই মন্দিরের তাৎপর্য:
বৈদ্যনাথে শিব এবং শক্তি একসাথে বিরাজমান এই মন্দিরে। তবে শিব ক্ষেত্র হিসেবেই বৈদ্যনাথ বেশি পরিচিত, এক সময়ে এই মন্দিরের কিছু দূরে শ্মশান ছিল, যেখানে মায়ের হৃদয় পড়েছে বলে মনে করা হয়, এই জায়গাটি বর্তমানে “চিতাভূমি” নামে পরিচিত সকলের কাছে। মায়ের হৃদয় পতিত হওয়ার এই শক্তিপীঠ “হৃদয় পিঠ” নামেও অনেকেই চেনেন।
বৈদ্যনাথ মন্দির এর সাথে মায়ের মন্দিরের চূড়া, লাল সুতো দিয়ে গাঁট বন্ধনে বাঁধা থাকে, ভক্তদের বিশ্বাস অনুসারে জানা যায় যে, এই পীঠে বর ও কনের একসঙ্গে বিবাহ দিলে তাদেরও বন্ধন অটুট হয় জনম জনমের মত।
প্রধান মন্দিরের সঙ্গে পার্বতী মন্দিরের এই সুতোর বন্ধন হিন্দু ধর্মীয় ব্যাখ্যায় শক্তি ও শিবের মিলনের প্রতীক বলে মনে করা হয়, প্রত্যেকটি সতীপীঠ অথবা শক্তি পিঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ, ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী অর্থাৎ দেবাদীদের মহাদেব এর রূপ বৈদ্যনাথ, দেবী হলেন জয় দুর্গা এবং ভৈরব হলেন বৈদ্যনাথ।
এছাড়াও এই মন্দিরে অথবা এই সতীপীঠে শিবরাত্রি পালিত হয় মহা ধুমধাম করে। বহু জায়গা থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী বছরের এই বিশেষ সময়ে এই মন্দিরে এসে ভিড় জমান। শিব ও পার্বতীর বিবাহের দিন হিসেবে এখানে পালিত হয় মহা শিবরাত্রি। ফলে এই অনুষ্ঠানের সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো শিবের বরযাত্রীর অনুষ্ঠান, যাকে “বারাত” বলা হয়।
আর এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্থানীয় মানুষজন দের প্রচেষ্টায় মেলা, উৎসব অনুষ্ঠানের শেষ নেই, যেখানে সকল স্থানীয় মানুষজন একসঙ্গে খুবই আনন্দ উপভোগ করে থাকেন মহা শিবরাত্রির এই পূজা উপলক্ষে। আর তার সাথে সাথে ভক্তদের আনাগোনা সারা বছরই প্রায় চলতেই থাকে বলা যায়।