তারকনাথ শিব মন্দির, পশ্চিমবঙ্গ – Baba Taraknath Temple

তারকনাথ শিব মন্দির (Baba Taraknath Temple): বিভিন্ন শিব মন্দিরের মধ্যে তারকেশ্বর শিব মন্দির খুবই জনপ্রিয় এবং জাগ্রত মন্দির বলে মনে করা হয়। এই তারকেশ্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি পূণ্য তীর্থের নাম। এই প্রসিদ্ধ হিন্দু তীর্থক্ষেত্রটি সারাদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। রাজ্যের সর্বোপরি জনপ্রিয় শিব মন্দির এই শহরে অবস্থিত। এই শহর রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে ৫৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তারকেশ্বর মন্দির।

সারা বছর তারকনাথ মন্দিরে পুণ্যার্থী দের ভিড় চোখে পড়ার মতো। প্রতি সোমবার এবং শ্রাবণ মাসের শ্রাবণী মেলাতে প্রচুর পরিমাণে জনসমাগম দেখা যায়। এছাড়া ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি ও চরিত্র সংক্রান্তিতে গাজন উৎসব হয় এখানে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। যেখানে বহু মানুষ এসে ভিড় জমান। তারকেশ্বর শিবের মন্দির এই শহরের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ বলে মনে করা হয়।

তারকনাথ শিব মন্দির, পশ্চিমবঙ্গ - Baba Taraknath Temple
তারকনাথ শিব মন্দির, পশ্চিমবঙ্গ – Baba Taraknath Temple

যেখানে মন্দিরের সামনে একটি নাট মন্দির আছে এবং খুবই কাছাকাছি কালি ও লক্ষীনারায়নের দুটি মন্দির আছে। মন্দিরের উত্তর দিকে আছে একটি পুকুর, যে পুকুরটির নাম দুধ পুকুর। কাহিনী এবং লোকেদের বিশ্বাস অনুসারে এই দুধ পুকুরে স্নান করলে মনের অনেক স্বপ্ন পূরণ হয়।।

তারকেশ্বর শহরে অবস্থিত বাবা তারকনাথের এই মন্দিরে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসেন বাবা তারকনাথের দর্শন করার জন্য। তাছাড়া হাজার হাজার মানুষ প্রতি দিন রাত এখানে পড়ে থাকেন। সকলের বিশ্বাস বাবা তারকনাথের আশীর্বাদে সকলের সমস্ত দুঃখ কষ্ট মুছে যাবে।

তারকনাথের মন্দিরের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী:

কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথের মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা বিষ্ণুদাস নামের একজন শিবের ভক্ত। উত্তর প্রদেশ থেকে এসে তিনি বসবাস শুরু করেছিলেন হুগলি জেলায়। তিনি ছিলেন অবাঙালি। ১৭২৯ সালে মন্দিরটি সংস্কার করেন মল্ল রাজারা।

লোক মুখে শোনা যায় যে, অনেকদিন আগে বিষ্ণুদাসের ভাই দেখেছিলেন স্থানীয় একটি জঙ্গলে একটি কালো পাথরের উপরে গরুরা নিয়মিত দুধ দান করে আসে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখার পরে তিনি তার দাদা বিষ্ণুদাসকে জানান সম্পূর্ণ ঘটনাটা।

আর এর পরেই স্বপ্নে বিষ্ণুদাস আদেশ পান এবং তারপর থেকে ওই পাথরটিকে শিব হিসাবে পূজা করা শুরু করেন। গড়ে ওঠে শিব মন্দির শিবের তারকেশ্বর রূপ অনুসারে এই মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে তারকনাথ মন্দির। বেশ অনেকবার এই শিব মন্দির কে মেরামত করা হয়েছে এবং পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।

শ্রাবণ মাসে মহাদেবের উপাসনা করা হয় খুবই ভালোভাবে। সেই কারণে শ্রাবণ মাসে বাবার মাথায় জল ঢালতে হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। কাঁধে করে বাঁকে করে জল বয়ে নিয়ে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হন প্রচুর মানুষ, হেঁটে উপস্থিত হতে হয় ভক্তদের। এর মধ্যে কষ্ট থাকলেও আনন্দটাই বেশি। কেননা বেশির ভাগ মানুষ কাঁধে করে জল নিয়ে রওনা হন বাবা তারকনাথ এর মাথায় জল ঢালার উদ্দেশ্যে, শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য তারকেশ্বরে পৌঁছান।

এছাড়া সারা বছর হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা থাকে এই মন্দিরে। “ভোলে বোম তারক বোম,” লাইনটা নিশ্চয় অচেনা নয়, কি তাই তো!  অনেকে সন্ন্যাস নিয়ে খালি পায়ে মাইলের পর মাইল কাঁধে করে জল বয়ে নিয়ে গিয়ে তারকেশ্বরে পৌঁছে শিবের মাথায় জল ঢেলে আসেন মনোষ্কামনা পূর্ণ হওয়ার আশায়।

তারকনাথ মন্দিরে মূল মন্দিরের বাম দিকে রয়েছে একটি পুকুর, যাকে সবাই দুধ পুকুর বলে চেনেন। তাছাড়া এই দুধ পুকুরকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন রকমের লোককথা এবং বিশ্বাস। এখনো হাজার হাজার মহিলা সন্তান কামনায় অথবা সন্তানের মঙ্গল কামনায় তারকনাথ মন্দিরে ছুটে আসেন এবং এই দুধ পুকুরে স্নান করেন। অনেকেই মনের ইচ্ছা পূরণ হওয়ার জন্য মন্দিরের বিভিন্ন দিকে ঢিল বেঁধে আসেন। মন্দিরের কাছাকাছি একটি কালী মায়ের মন্দিরও রয়েছে।

কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, বর্তমানে তারকেশ্বর মন্দির মল্ল রাজাদের হাতে তৈরি। শোনা যায় যে স্বপ্নে আদেশ পেয়ে মল্ল রাজা  ১৭২৯ সালে এখানে মন্দির তৈরি করেন। রাজবাড়ী থেকে তারকনাথ মন্দিরের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। আর এতটা পথ হেঁটে গিয়ে রানীমার তারকেশ্বরে পূজা দিতে অনেক অসুবিধা হতো, রানিমার কষ্ট কমাতে মল্ল রাজা সেই পরিকল্পনা শুরু করে মন্দিরটি স্থানান্তরিত করার চিন্তাভাবনা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরানো মন্দির ছেড়ে দেবাদিদেব মহাদেব যেতে চাননি, তাই রাজবাড়ীর কাছে নতুন মন্দির নির্মাণ করতে বাধ্য হন মহারাজ।।

স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ ছাড়াও মন্দিরে রয়েছে বাসুদেব, দ্বিমতের ব্রহ্মা, তারকনাথ মন্দির বাংলার চালা স্থাপত্যের আদর্শ উদাহরণ। যে কয়েকটি প্রাচীন চালা মন্দির বাংলায় আছে তার মধ্যে তারকনাথ মন্দির হলো অন্যতম।

নামকরণ অনুসারে তারকেশ্বরের মহাদেব কে বলা হয় স্বয়ম্ভু লিঙ্গ, কারণ তারকেশ্বরের শিবলিঙ্গ কেউ কখনো স্থাপন করেননি, অন্যদিকে গঙ্গার পলি ভূমিতে এই ধরনের পাথর পাওয়াও খুবই অসম্ভব বিষয়। তাই মনে করা হয় শিব এখানে স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাছাড়া মন্দির সংলগ্ন যে দুধ পুকুর রয়েছে সেই দুধ পুকুরে অলৌকিক শক্তি আছে বলে মনে করা হয়। কেননা এই পুকুরে স্নান করলে অনেকের আরোগ্য প্রাপ্তি হয়েছে।

এছাড়া শিব মন্দির হিসাবে মহা শিবরাত্রি এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে তারকনাথ মন্দিরে বিশেষ উৎসব পালিত হয়। প্রতি সোমবার এখানে বিশেষ পূজা করা হয় শিবের। তবে শ্রাবণের সোমবার গুলিতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত এখানে এসে শিবের মাথায় জল, দুধ, ডাবের জল ঢালেন তাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য।

অনেকদিন আগে সবাই পায়ে হেঁটেই রওনা দিতেন তারকেশ্বর এ পৌঁছানোর জন্য। তবে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত যে আপনি কিছুটা পথ গাড়িতে যেতে পারবেন, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে কাঁধে বাঁক নিয়ে জল ভরে খালি পায়ে ভক্তদের সাথে মন্দিরে পৌঁছানোর এই রীতিটা এখনো পর্যন্ত বিরাজমান। আর এমন করেই লক্ষ লক্ষ ভক্ত তারকনাথ মন্দিরে পৌঁছে শিবের মাথায় জল ঢালেন এবং ভক্তি ভরে পূজা করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top